যে কারণে বাংলাদেশকে কাছে টানছে তুরস্ক
ভৌগোলিক অবস্থান এবং ভূ-রাজনীতির কারণে দক্ষিণ এশিয়ায় ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে বাংলাদেশ। ফলে পাকিস্তানের পর এ দেশেও বাণিজ্যিক, কূটনৈতিক ও সামরিক প্রভাব বাড়াতে চাইছে তুরস্ক।
আধুনিক মুসলিম বিশ্বে প্রভাবশালী হয়ে উঠা দেশটির চীন ও পাকিস্তান ঘেঁষা নীতিতে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে অবনতি হয়। কাশ্মিরসহ নানা ইস্যুতে দেশ দুটির মধ্যে তিক্ততা তৈরি হয়েছে সম্প্রতি। অন্যদিকে, পাকিস্তানকে চাপে ফেলতে সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন আরব দেশগুলোর দিকে ঝুকছে ভারত। এসব দেশে বাণিজ্য, কূটনীতি ও সামরিক সম্পর্ক জোরদার করেছে নয়াদিল্লি।
এমন প্রেক্ষাপটে ভারতের ঘনিষ্ট মিত্র বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম জন্যসংখ্যার দেশ বাংলাদেশকে কাছে টানছে তুরস্ক। এরই মধ্যে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকা সফর করে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি সম্পর্ক বহুমাত্রিক করতে নিজেদের ভরসার কথা জানান।
এ নিয়ে আজ শনিবার দ্য ইউরেশিয়ান টাইমসে একটি বিশ্লেষণমূলক প্রতিবেদন লিখেছেন ভারতীয় সাংবাদিক স্মৃতি চৌধুরী। এতে বলা হয়, দিল্লির সব সময়ের মিত্র বাংলাদেশে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বাড়াতে তৎপর হয়েছে তুরস্ক। এ বিষয়ে উভয় দেশের মধ্যে আলোচনাও এগিয়ে চলছে।
সম্প্রতি দুইদিনের সফরে ঢাকায় এসেছিলেন তুর্কি পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুত কাভুসোগলু। সেখানে তুর্কি দূতাবাসের নতুন ভবন উদ্বোধন করেছেন তিনি।
সফরকালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে তুর্কি মন্ত্রীর। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বৃদ্ধিতে যা যা দরকার, সবই করতে রাজি তুরস্ক।
এদেশের ক্রমবর্ধমান অর্থনীতি এবং তরুণ জনসংখ্যার ভূয়সী প্রশংসা করে মেভলুত কাভুসোগলু জানিয়েছেন, তুরস্কের ‘এশিয়া এনিউ’ উদ্যোগের অন্যতম প্রধান অংশীদার বাংলাদেশ।
বৈঠকের বিষয়ে ড. মোমেন স্থানীয় গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, নির্ধারিত এজেন্ডায় না থাকলেও বৈঠকে দুইপক্ষের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। তুর্কি মন্ত্রী এ বিষয়ে তাদের মতামত জানিয়েছেন।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, তুরস্কের মন্ত্রী জোর দিয়ে বলেছেন, তার দেশ বিশ্বমানের সামরিক সরঞ্জাম উত্পাদন করছে এবং সেগুলো বিক্রিতে কোনও ধরনের শর্ত আরোপ করে না।
আব্দুল মোমেন বলেন, এ বিষয়ে তাত্ক্ষণিক কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা বিষয়ক কেনাকাটার উৎসে বৈচিত্র্য আনতে চায়।
২০১৩ সালে তুরস্কের কাছ থেকে অটোকার কোবরা সাঁজোয়া যান কিনেছিল বাংলাদেশ। এরপর ২০১৭ সালে ডেল্টা ডিফেন্স নামে একটি তুর্কি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ১০০ কোটি ডলারের বিনিময়ে ৬৮০টি হালকা সাঁজোয়া যান কেনার অর্ডার দেয়া হয়। ২০১৯ সালে আরেক তুর্কি প্রতিষ্ঠান রকেটসানের কাছ থেকে মাঝারিপাল্লার রকেট লঞ্চার কেনার অনুমতি দিয়েছে ঢাকা।
১৯৭৪ সালে তুরস্ক বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার পর থেকেই দুই দেশের মধ্যে উষ্ণ সম্পর্ক বিদ্যমান। তবে ২০১২ সালে বাংলাদেশে ’৭১ সালে যুদ্ধপরাধের দায়ে জামায়াতে ইসলামী নেতাদের বিচার শুরু হলে এর নিন্দা জানায় আঙ্কারা। এঘটনায় দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কে কিছুটা ভাঁটা পড়েছিল।
তবে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে জাতিসংঘ, ইসলামী সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) মতো জায়গাগুলোতে বাংলাদেশকে বরাবরই সমর্থন দিয়েছে তুরস্ক।
দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের পর বাংলাদেশই তুরস্কের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার। অবশ্য গত কয়েক বছর ধরে দিল্লি-আঙ্কারা সম্পর্ক খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করায় ভারত সরকারের কড়া সমালোচনা করেছে তুরস্ক। কাশ্মীর ইস্যুতে তারা বরং পাকিস্তানেরই পাশে দাঁড়িয়েছে। বিষয়টি জাতিসংঘেও উপস্থাপন করায় তুরস্কের ওপর বেশ ক্ষিপ্ত ভারত।
তুরস্ক বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন পশ্চিমাদের প্রাধান্য দিয়েছে। ক্ষমতার শেষবেলায় এসে সম্প্রতি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তুরস্কের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন। তারা রাশিয়ার কাছ থেকে ক্ষেপণাস্ত্র সুরক্ষা ব্যবস্থা এস-৪০০ কেনায় এই নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
ভারতীয় থিংক ট্যাঙ্ক বিবেকানন্দ ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশনের সহযোগী গবেষক ড. যথার্থ কোচিয়ার বলেন, পশ্চিমাদের সঙ্গে সম্পর্কে ফাটল বৃদ্ধি এবং মুসলিম বিশ্বে চলমান আধিপত্যের লড়াই তুরস্ককে তার ঐতিহ্যবাহী মিত্র, পশ্চিমা এবং প্রতিবেশী ইসলামী দেশগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে তারা এশিয়ার মতো কম সংকটপূর্ণ অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারের বাজি ধরছে।